আমেরিকা বনাম চিন, বা গণতন্ত্রের কোষ্ঠীবিচার https://ift.tt/tnA7CS9 - MAS News bengali

আমেরিকা বনাম চিন, বা গণতন্ত্রের কোষ্ঠীবিচার https://ift.tt/tnA7CS9

চিন-মার্কিন সম্পর্কের বর্তমান অভিমুখ কোন দিকে তা আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করতে, সুস্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে, সংসদীয় স্তরে তার তদারকি করতে চিনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে এই মুহূর্তে কে কোন দায়িত্বে রয়েছেন, তার এক পূর্ণাঙ্গ সচিত্র আখ্যান সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, গত বছরের শেষ দিকেই বিদায়ী জো বাইডেন বলেছেন, বিশ্বশাসন বা বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে আমেরিকা তার ‘একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী’ চিনের উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে। বৃহত্তর প্রেক্ষিতে এটি ‘গণতন্ত্র ও স্বৈরাচার’-এর মধ্যে প্রতিযোগিতা বলে কংগ্রেসে পেশ করা এক রিপোর্টে বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তীব্র আক্রমণ করে চিন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছে, ‘গণতন্ত্র’ আমেরিকায় প্রস্তুত ‘কোকা-কোলা’ নয়। হঠাৎ কেন ‘কোকা-কোলা’র সঙ্গে গণতন্ত্রের তুলনা টানতে গেল পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না? অ্যাটলান্টা শহরের কেন্দ্রস্থলে বিশ্বের যে বৃহত্তম অ্যালকোহলমুক্ত পানীয় উৎপাদন কেন্দ্র কোকা-কোলা গড়ে তুলেছে, সেখান থেকে এই মুহূর্তে ২০০-র বেশি দেশে ওই পানীয় রপ্তানি করা হয় এবং প্রতি দিনই যে ২.২ বিলিয়ন ‘সার্ভিংস’ করা হয়, তাদের স্বাদ ‘অভিন্ন’। চিনের যুক্তি হল, ‘কোকা-কোলা’র স্বাদের মতো গণতন্ত্রের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। গণতন্ত্রের প্রকাশভঙ্গি, তার গঠন, পরিচালন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সার্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। চিনা যুক্তির সপক্ষে বলা হয়, গণতন্ত্র যদি একই ছাঁচে গড়া হত, তা হলে দু’দশকের যুদ্ধ অসম্পূর্ণ রেখে, সেনা প্রত্যাহার করে, আফগানিস্তানে ‘পশ্চিমি গণতন্ত্র’ চাপানোয় ব্যর্থ হয়ে, তালিবানদের হাতে শাসন হস্তান্তরিত করে আমেরিকাকে ফিরে যেতে হত না।অন্য দিকে, মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করা সর্বশেষ রিপোর্টে উল্লিখিত চিনের ‘স্বৈরাচারী শাসন’-এর ইঙ্গিতকে হাতিয়ার করে, চলতি মাসের গোড়াতেই চিন এক বাৎসরিক রিপোর্টে কড়া আক্রমণ শানিয়েছে বাইডেন সরকারের বিরুদ্ধে। কিছু দিন আগে আমেরিকার বিভিন্ন কলেজে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে ‘সাধারণ নয়, অভিজাত’ পরিবার থেকে আসা পড়ুয়াদের সঙ্গে কলেজ প্রশাসনের সংঘর্ষের উল্লেখ করে জিনপিং সরকার-পোষিত ‘গ্লোবাল টাইমস’-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, মার্কিন সংবিধানে স্বীকৃত সমাবেশ এবং সংগঠন করা, মিছিল এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনের অধিকারের মতো নাগরিক অধিকারকে বাইডেন সরকার ‘নির্লজ্জ ভাবে লঙ্ঘন’ করছে।চিনের তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ প্রকাশভঙ্গি ও তার কাঠামোর রূপরেখা নিয়ে ব্যাখ্যার আগে দেখা যাক, আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে মার্কিন গণতন্ত্রের অবস্থান কোথায়। ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’-এর প্রস্তুত করা, সর্বশেষ (২০২৪) প্রকাশিত ডেমোক্র্যাসি ইন্ডেক্স রিপোর্ট অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তি ৭.৯২, অর্থাৎ ইইইউ-র সংজ্ঞা অনুযায়ী আমেরিকার গণতন্ত্র ‘ত্রুটিপূর্ণ’, ইংরেজি পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘ফ্লড ডেমোক্র্যাসি’। ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’-এর স্বীকৃতি পেতে গেলে কোনও দেশকে কমপক্ষে ৮ পেতে হবে। প্রথমে উল্লিখিত রিপোর্টে কংগ্রেসের সদস্যদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, চিন বিশ্বের একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি-শাসিত দেশ যে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রথম সারির দেশগুলির সম্মিলন জি২০ গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে তীব্র কৌশলগত প্রতিযোগিতার প্রেক্ষিতে, চিনের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসের নজরদারি ও তদারকি এবং আইনি কার্যক্রম আরও শক্তিশালী ও পরিধি বিস্তৃততর করার দিকে নজর দেওয়া হয়েছে।চিনের পার্টি ও সেখানকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন করে পরিচয় করাতে গিয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না ‘একই সঙ্গে একটি জাতিরাষ্ট্র (নেশন স্টেট) ও একটি লেনিনবাদী পার্টি-স্টেট’। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির অধীনে আছে এক ‘শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত আমলাতন্ত্র। দেশের সর্বত্র, সব ধরনের কাজে পার্টিই নেতৃত্ব দিয়ে থাকে।’ প্রতিটি স্তরেই দলের নেতারা পদাধিকার বলে প্রধানমন্ত্রী, প্রাদেশিক গভর্নর ও মেয়রদের থেকে বেশি ক্ষমতাবান।‘শৃঙ্খলাপরায়ণ ও দুর্নীতিমুক্ত’ এক কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে চিনকে গড়ে তোলায় শি জিনপিং সরকার দলীয় স্তরেও যে কতটা কঠোর, তার প্রমাণ সেন্ট্রাল কমিশন ফর ডিসিপ্লিন ইন্সপেকশন-এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২২ সালে যত নেতার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গ ও দুর্নীতির তদন্ত হয়েছে তার মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির মোট ৬১ জন পূর্ণ ও বিকল্প সদস্য এবং কমিশনের নিজস্ব ১৮ জন সদস্য আছে। শি জিনপিং যে বছর দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, তখন থেকে এক দশকের বেশি সময় ধরে দলের কয়েক লক্ষ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া, গত বছর অক্টোবর মাসে শি জিনপিং ফের দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হওয়ার পর দু’জন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীকে অভ্যন্তরীণ তদন্তের পররাষ্ট্রীয় পরিষদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এদের একজন প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী কুইন গ্যাং ও অন্যজন প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফু।দল ও দেশের সর্বাধিনায়ক শি জিনপিং-এর সার্বিক ক্ষমতার নিরিখে মার্কিন কংগ্রেসের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে জিনপিং দলের সাধারণ সম্পাদক ও পার্টির কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান পদের দায়িত্বে আসীন। পিপলস লিবারেশন আর্মি-র (পিএলএ) তদারকি করে থাকে এই মিলিটারি কমিশন। দলের সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ থেকে জিনপিং এখনও পর্যন্ত চিনের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন। মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করা রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭৪ বছরের শাসনে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা ৯ কোটি ৮০ লক্ষে পৌঁছেছে, যা চিনের জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশ। দলের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছে পলিটব্যুরোর ২৪ জন এবং এদের থেকেও বিশেষ ভাবে বাছাই করা পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা শি জিনপিং-সহ সাত। এই প্রসঙ্গে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সর্বস্তরে দেশের রাজনৈতিক জীবনযাত্রার উপর দলের নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করতে রাজনৈতিক কাঠামোর নানা স্তরে যারা সর্বোচ্চ পদে আসীন, তাদের মাথার উপরে পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির বেশ কিছু সদস্যকে বসানো হয়েছে। তাদের গণতন্ত্র জনগণের ক্ষমতার প্রতিফলন বলে চিন যতই গলা ফাটাক না কেন, দেশের জনগণ পিপলস কংগ্রেসের প্রায় ৩ হাজার প্রতিনিধিকে নির্বাচন করতে পারে না। নজর রাখা যাক, জিনপিংয়ের দেশে গণতান্ত্রিক প্রয়োগ-পদ্ধতির কাঠামোর দিকে। ওয়াং হুনিংয়ের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা সংস্থা চাইনিজ় পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি) মূল দায়িত্ব হল, অন্যান্য সংখ্যালঘু অথচ শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়নার অনুগত সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব বিস্তার করে দলের প্রতি সমর্থন আদায় করা। মূল লক্ষ্য হল, এক ‘দেশপ্রেমিক ঐক্যফ্রন্ট’ গড়ে তোলা। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আমলাতন্ত্রের দেখভালের দায়িত্ব দলীয় সচিবালয় ও তার সম্পাদক কাই কুই-এর উপর। দলের বিভিন্ন উচ্চক্ষমতা-সম্পন্ন কমিশনের অফিসগুলোও আমলাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে আছে পররাষ্ট্র বিষয়ক কেন্দ্রীয় কমিশন, যার ডিরেক্টর পলিটব্যুরোর সদস্য এবং চিনের একজন শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ওয়াই। গুরুত্বের দিক থেকে চিনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় পরিষদ বলা হয়। প্রধানমন্ত্রীর ঠিক নীচে আছেন চার উপপ্রধানমন্ত্রী, কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না-র পলিটব্যুরোর সমস্ত সদস্য। তার নীচের স্তরে আছেন সব রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর। দলীয় রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও প্রশাসনের সর্বস্তরে কঠোর নিয়ন্ত্রণের ছাঁচে তৈরি করা এই কর্মকাণ্ডকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে জিনপিং সরকার ‘চৈনিক গণতন্ত্র’ বলে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত এই গণতন্ত্রও চিনপন্থী ও অন্যান্য কমিউনিস্ট-শাসিত দেশে ‘অভিন্ন’ স্বাদের।গণতান্ত্রিক দেশ বলে যতই আত্মশ্লাঘা থাকুক না কেন, ‘পূর্ণ বা কার্যকরী’ গণতন্ত্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখনও স্বীকৃতি মেলেনি। শুধুমাত্র ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট নয়, গণতন্ত্র সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ডেমোক্র্যাসি ম্যাট্রিক্সের সর্বশেষ রিপোর্টেও ‘কার্যকরী গণতান্ত্রিক’ দেশ বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম নেই। পাশাপাশি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ও ১৪৩ কোটি (চলতি বছরের শুরুতে) জনসংখ্যার দেশ চিনকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘কঠোর স্বৈরাচারী’ দেশ হিসেবে।এক কথায়, এই রিপোর্টকে বলা যেতে পারে পশ্চিমি দৃষ্টিতে স্বৈরতন্ত্রের আস্তরণে চৈনিক গণতন্ত্রের ‘সহজ পাঠ’। এখন দেখার, মার্কিন কংগ্রেসে চিন-চর্চার ফলাফল কী দাঁড়ায় ।


from Bengali News, বাংলা নিউজ, বাংলায় সর্বশেষ খবর, Live Bengali News, Bangla News, Ajker Bengali Khabar - Eisamay https://ift.tt/I3r0Yqu
Previous article
Next article

Leave Comments

Post a Comment

ads

Articles Ads 1

ads

Advertisement Ads